#ভুটানি#সৌরভ_কুমার_নাথ

#ভুটানি
#সৌরভ_কুমার_নাথ

ভরা শ্রাবণ মাস চলছে। রোদ ঝলমলে দুপুর। হঠাৎ মায়ের ইচ্ছে সবাই মিলে ছবি তুলতে যাওয়া হবে। যেই সময়ের কথা বলছি তখন ছবি তুলতে যাওয়া মানে বিরাট ব্যাপার। সবাই মিলে সেজে গুজে স্টুডিও তে ছবি তুলতে যাওয়া, তারপর সেই ছবি বাড়িতে আসলে সবাই মিলে দেখা, একটা ছোটখাটো উৎসব ছিল। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে খুশির কোনো অভাব ছিল না। সবাই তখন মোটামুটি যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
 বাবা কে যখন বলা হল, এক কথায় সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল। এই ভর বর্ষায় বিকালে এতটা দূর যাওয়া ঠিক হবেনা। শুনে দিদির কি কান্না, কপালের টিকলিটাও খুলে ফেলেছে তখন। সবাই তখন মোটামুটি বুঝে গেছে, বাবা না করেছে মানে আর যাওয়া হবেনা। সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে। একটাই পথ ঠাকুমাকে দিয়ে যদি বাবাকে বলানো যায়। আমরা চারজন গিয়ে ধরলাম ঠাকুমাকে। শেষ পর্যন্ত ঠাকুমা রাজি হল।
     খোকা! হ্যারা যাইতে চায়, রোজ রোজ তো চায়না। লইয়া যা না। পোলাপানের মুখগুলান দেহন যায়না।
কি যে কউ না মা এই ভর বর্ষায় কেই এত দূরে হাইটা যায়, যহন তহন বৃষ্টি নামতাসে। 
তুই হ্যাগো লইয়া যা। কিচ্ছু হৈবোনা।
অত:পর ছবি তুলতে যাওয়া হবে, সেই প্রস্তাবে সিলমোহর পড়লো।
তাহেরপুর থেকে বীরনগর প্রায় দু কিলোমিটার পথ। সেই সময় গ্রামের মানুষ বেশিরভাগ হেঁটেই চলাচল করত। রিকশাভ্যান কিছু ছিল কিন্তু সবার জন্য নয়। যখন বেরোনো হয়েছিল তখন বিকাল পড়ে গেছে। ছাতা সেই যুগে খুব কমই ব্যাবহার হতো। ছাতাটা নিয়েও বেরোনো হয়নি, আর নিয়েই বা কি হবে ছয় জন মানুষের জন্যে একটা ছাতা দৃশ্যতই অপর্যাপ্ত।
স্টুডিওর ভেতরের সাজসজ্জা দেখে সবাই অবাক। এর আগে আমারা কোনোদিন স্টুডিও তে আসিনি,বাবা মা এসেছিল একবার বিয়ের পর। 
কত ছবি, কত সিনারি, সে একেবারে দেখার মতন। বেশ কটা ছবি তোলা হল। তখন কিন্তু এখনকার মতন ছবি তোলার পরেই দেখা যেত না ক্যামেরার ভিতরে ফিল্ম ভরা থাকতো, সেই ফিল্ম ডেভেলপ করার পর ছবি পাওয়া যেত।
ছবি তুলে বেরিয়ে দেখি বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাবা আকাশের অবস্থা দেখে বলল, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে তাড়াতাড়ি পা চালাও। বেশি দূর যেতে হল না পদ্মপুকুর টা পার হবার পরেই শুরু হয়ে গেল । মুষলধারে বৃষ্টি আর সাথে ঝোড়ো হওয়া। তার মধ্যে অন্ধকার রাত্রি, বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে কোনোমতে অনুমান করে রাস্তা চলতে হচ্ছে। সবাই ভিজে একসার অবস্থা। ছোট বাজারটার কাছে যখন পৌঁছেছি, রাস্তায় তখন জল দাঁড়িয়ে গেছে। খানাখন্দ খাল বিল সব একেবারে ভরপুর। সেই সময় ইলেকট্রিক ছিল না আর রাস্তার আলো তো ভাবতেই পারা যেতনা।

 হটাৎ সামনে মনে হল কিছু মানুষ হাঁটছে। ক্ষনিকের আলো তে খুব ভালো করে বোঝাও যাচ্ছেনা। মনে হলো একজন সাদা শাড়ি পরিহিতা মহিলা দুই সন্তান কে নিয়ে চলেছে। আমরা জোরে হেঁটেই ধরতে পারছিনা। হটাৎ একটা ঝলকানিতে মনে হলো তিনজনের মধ্যে একজন নেই। যেন হটাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল একজন। আমরা প্রত্যেকে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। এরকম অন্ধকার রাস্তা তার মধ্যে মুসলধারায় বৃষ্টি সেই সাথে এরকম দৃশ্য, ভয় একটু পাওয়ার কথাই বটে।
হটাৎ একটি চিৎকার আমাদের কানে এলো। এক ভদ্রমহিলার চিৎকার কিন্তু কোথা থেকে আসছে তা বোঝা যাচ্ছেনা। এই অন্ধকারে, ছয়জন লোক তবুও একটু অসহায় লাগলো। প্রথমটায় আগাতে সাহস পাইনি, কি দেখতে কি দেখেছি কিন্তু যখন ছোট ভাইটা চিৎকার করে বললো কে গো ওখানে, তখন বুঝতে পারলাম আমি যা দেখছি সবাই তাই দেখছে।সাহস করে একটু এগিয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছে?
এক মহিলা কাঁদছে, শুনে মনে হলো বলছে ভুটানি!ভুটানি! ভুটানের লোকেদের ভুটানি বলা হয় বলে পড়েছিলাম ভূগোল বইয়ে। পাশে আরেকটা বাচ্চা সেও কাঁদছে। আর দুজনে অন্ধকারে কিছু একটা হাঁতড়ে খুঁজছে। আমরা ভাবলাম হয়তো দামি কিছু পড়ে গেছে। আমরাও কাজে হাত লাগলাম কিন্তু কি খুঁজতে হবে তা বুঝতে পারলাম না। 
হটাৎ একটা বাচ্চার ডাকে আমাদের ঘোর ভাঙলো। মা! আমি এহেনে। গর্তে পইড়া গেছি। দেখলাম রাস্তার পাশে একটা গর্তে একটা বাচ্চা গলা জলে দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে ঠিক করে ঠাহর করতে না পারলেও মনে হল একটা বাচ্চা মেয়ে। ভদ্রমহিলা আবার চেচিয়ে উঠলো আমার ভুটানি আমার ভুটানি। আমরা তো অবাক মেয়েটার নাম ভুটানি যাই হোক বাবা গিয়ে ভুটানি কে উদ্ধার করলেন গর্ত থেকে। জানা গেল বাড়িটা কাছেই খাঁ পাড়ার দিকের রাস্তাটায়। বাড়ির কাছাকাছি রাস্তাটা দিয়েই ঢুকতে হয় ওদের গ্রামে। এর মধ্যে বৃষ্টি টা ছেড়েছে আকাশটাও খোলতাই হয়েছে।চাঁদ ও উঠেছে পূর্ণিমার। বাবা ভেজা গায়েই আমাদের বাড়ি ছেড়ে ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো হারিকেন টা নিয়ে।
ওই ঝড় জলের রাতের পুরো ব্যাপার টা জানতে পারলাম পরের দিন। ভুট্টো আর ভুটানি কে নিয়ে ওদের মা খেন্তকালী গেছিলো পাশের পাড়ায়  কালীতলায় পূজা দিতে, ভুটানির বাপ বিদেশ থেকে ফিরেছে সেই খুশিতে। ফেরার পথে গন্ডগোল, মুষলধারে বৃষ্টি তার সাথে ভুটানির অন্তর্ধান। সব মিলে মিশে একেবারে বিচ্ছিরি অবস্থা। কালকের বৃষ্টিতে বাবার একটু ঠান্ডা লেগেছে, তাই নিয়ে সকাল থেকেই গাল মন্দ চলছে। ঠাকুমা এসে বললো খোকা তুই ভাব তুই না হইলে কেডা ভুটানিরে বাচাইতো ক তো? আমরা সবাই মুখ চাপা দিয়ে হাসলাম। 
পরে ভুটানির বাপ এসেছিল আমাদের বাড়ি ভুটানি আর ভুট্টো কে নিয়ে বাবাকে ধন্যবাদ জানাতে। ভুট্টো বাচ্চা ছেলেটার নাম। বাবা জিজ্ঞাসা করেছিল ভুটানির এরকম অদ্ভুত নামকরণের কারণ। ভুটানির বাবা বললো আসলে ভুটানি যখন হল তখন ভুটানির বাবা বাড়িতে ছিলোনা, অশিক্ষিত খেন্তকালী ভুট্টোর সাথে মিলিয়ে রাখতে গিয়ে নিজেই মেয়ের নাম ভুটানি রেখেছে। সেই বৃষ্টির রাতে আমাদের হটাৎ ভুটানি দেখার ব্যাপারটাই কিন্তু আলাদা ছিল।আজও ভুলতে পারিনি।

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

Comments

Popular posts from this blog

#অনুগল্প#মোটিভ#সৌরভ_কুমার_নাথ

#ছোট_গল্প#বিজানুর_বিষে_নারদ#সৌরভ_কুমার_নাথ

#অসুখ