#ছোট_গল্প#অমলের_সেই_দিনটা#সৌরভ_কুমার_নাথ

#ছোট_গল্প
#অমলের_সেই_দিনটা
#সৌরভ_কুমার_নাথ

অমল যখন হেড অফিস থেকে বেরোলো তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদা যেতে হবে তার পর আবার সাতটার শান্তিপুর লোকাল। আকাশটাও কেমন যেন থমকে আছে। আকাশে মেঘ বেশি নেই বটে তবুও কেমন যেন গুমরে রয়েছে।
সেই সকাল ছটায় বেরোনো তার মধ্যে আবার এতদূর আসার অভ্যাস নেই, খুব ক্লান্ত লাগছিল অমলের। সারাদিন ঠিক করে খাওয়াও হয়নি ওর। অফিস থেকে এতদূর অফিসের কাজে আসতে হবে শুনে বাকিরা পালিয়ে গেলেও অফিসের বয়স্ক বড় বাবুর অনুরোধ ফেলতে পারেনি অমল। গত বছরই এসিস্টেন্ট হিসাবে অফিসের এস্টাব্লিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেছে। চতুর্থ শ্রেণীর যে কর্মচারী টি এই কাজটি করত বর্তমানে পা ভেঙে বাড়িতে, অগত্যা।
সকালেই পৌঁছে যাবার কথা কিন্তু কপালের নাম গোপাল। রেল বহির্ভুত কারণে বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রেন লেট। তার পর আবার বাস-ট্রাম চেনা নেই, অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত লাঞ্চের সময় গিয়ে কোনো মতে অফিসে পৌছালো অমল। অনেক সকালে বেরিয়েছে, আর বরাবরই বাইরের খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই পেট রোগ অমলের তাই রাস্তায় কিছু খাওয়া হয়নি।
যে ভদ্রলোক শান্তিপুরের দায়িত্বে আছেন তার টিফিন করা শেষ হয়নি অগত্যা আরো আধ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। শেষে ভদ্রলোক যখন এলেন তখন প্রায় পৌনে চারটা বেজে গেছে।
আরে মশাই আপনার তো সকালে আসার কথা, আপনারা সব কাজ শেষ দিন অব্দি ফেলে রাখবেন আর যত ঝক্কি সব আমাকে পোহাতে হবে। এ আপনাদের কিরকম আবদার বাপু।
দিন! দিন! কাগজ গুলো দিন তো। আবার আমার এগুলোকে ঠিক ঠাক করতে হবে।
অমল কাগজ গুলো এগিয়ে দেবার পর মুখের দিকে আর চোখে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন।
সেকি জেরক্স আনেন নি ? আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো? যান নীচে থেকে জেরক্স করে আনুন সব।
পেট ক্ষীদেয় ছুঁই ছুঁই করছে তার মধ্যে সব ঝক্কি সামলে সব কিছু সেরে কোনোমতে অফিস থেকে বেরোলো অমল।
কি জানি সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম। দিনটা জঘন্য গেল। আর খেয়ে দরকার নেই এই ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে অমল দেখলো ব্যাপক জ্যাম। সব বাস-গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এমত অবস্থায় কি করা যায় তাই ভাবতে ভাবতে খিদে আর ক্লান্তির কথা ভুলে গিয়ে শেষে হেটে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো অমল। পকেট থেকে হজমি গুঁড়ো বার করে মুখে চালান করলো অমল, ওটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। আজ একটু অন্য রকম লাগছে গুঁড়ো টা।

আকাশ টা একটু থমথমে ছিল বটে কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে কোথা থেকে মেঘ এসে পুরো আকাশটাকে অন্ধকার করে দিল। যাদের অনুসরন করে রাস্তা চেনার ভরসায় পথে নেমেছিল অমল, সেই মানুষ গুলো হটাৎ করে কেমন যেনো কর্পূরের মত উবে গেল। শুরু হয়ে গেল বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রচন্ড বৃষ্টিপাত। কাগজ পত্র ব্যাগের ভিতরে ফাইলে আছে তাই সেগুলো নষ্ট হবার সুযোগ নেই আর এই ঝড়ের মধ্যে ছাতা খুলে যাওয়াটা কি ধরণের বোকামি সেটা অমল ভালোই জানে। সুতরাং সব শেষে ভিজে ভিজে স্টেশনে যাওয়া ছাড় আর কিছু গতি রইলনা।

কলকাতায় সচরাচর লোডশেডিং হয়না কিন্তু সেদিন হটাৎ পুরো কলকাতাটাই যেন অন্ধকার হয়ে গেল, যেন গোদের উপর বিষফোড়া।
অমল জানে ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে আগালে ঠিক মৌলালি পৌঁছে যাবে। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির সেই রাতে গহীন অন্ধকারে হাটু জল ঠেঙিয়ে চলা যেন কঠিন হয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন সুন্দরবনের সমুদ্রতীরে সুন্দরীগাছের জঙ্গলে হাটু জলে একা একা হেটে চলেছি। এরকম কোনোদিন দেখিনি। একটাও জন মানব নেই এই মহানগরীর এই সবচাইতে ব্যস্ততম রাস্তায়। কোনো দোকানে সামান্য একটা টর্চ বা ল্যাম্প জ্বালানো নেই। বড়ই অদ্ভুত লাগে অমলের। এ যেন এক অচেনা মৃত্যুপুরী তে পৌঁছে গেছে। ফিরবার কোনো পথ নেই বলেই মনে হচ্ছে। 
আস্তে আস্তে ঝড় বৃষ্টি কমে এলো কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশটা একেবারে পরিষ্কার, জলটাও যেন নেমে গেল হটাৎ করে। কিন্তু একি?
এ যেন এক পুরোনো মফস্বলের গলিতে হেটে চলেছি। কোথায় ব্যাবসায়িক দোকানে ভর্তি ধর্মতলা, মৌলালি মোড়? এ কোথায় এলাম আমি, মনে মনে ভাবে অমল। মনে হয় নির্ঘাত রাস্তা ভুল করেছি। 
সামনে এক ভদ্রলোক কে দেখে বুকে একটু বল পেল অমল। ভদ্রলোক পরনে ধুতি গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। এই কলকাতা শহরে ধুতি পাঞ্জাবি পড়া মাঝবয়সী লোক? বিশ্বাস করতে পারছে না অমল।
দাদা শিয়ালদা স্টেশন টা কোন দিকে? 
কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। একটু অবাক হয়ে অমল আবার বললো দাদা শিয়ালদা....
হটাৎ যেন লোকটা অমলের খুব কাছে দিয়ে সাঁই সাঁই করে হেটে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার টা অস্বাভাবিক। মানুষের শরীরের এত কাছে দিয়ে কোনো মানুষ যেতে পারেনা। তার মধ্যে আবার পুরো রাস্তা ফাঁকা।
এই ফাঁকা রাস্তায় ব্যাপার টাকে অনুধাবন করে যে তাৎক্ষণিক ভয়ের সূচনা হল তা বোধহয় ছোট বেলায় পড়া সেই রহস্য রোমাঞ্চ বইয়ের থেকেও ভয়ঙ্কর। এমন সময় মনে হলো আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে শরীরটা, যেন মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে অমল। পায়ের দিকে তাকিয়ে অমলের বিস্ময়ের শেষ রইলো না। পায়ের পরেই এক গভীর খাদ, তল দেখা যাচ্ছেনা। মাথা তুলে দেখলো তাঁরা গুলো যেন ওর দিকে এগিয়ে আসছে, মহাকাশের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন।
চোখটাকে জোর করে খুলে, অনেকটা পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগালো অমল। কোথায় যাচ্ছে চারিদিকে কি চলছে বোঝার মতো সময় নেই। শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ানোটাই সমীচীন মনে হল। কিন্তু কোথায় কি? ফুটপাথ টা যেন চওড়া হওয়া শুরু করেছে। এত বিশাল ফুটপাথ ও হতে পারে আমল ভাবতেও পারেনা। পিঁপড়ে গুলো এত বড় হয়ে গেল কি করে। হটাৎ কোথা থেকে একটা বড় পাতা এসে পড়ল উপরে। এত বড় পাতা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কেমন একটা ঘুম ঘুম পাচ্ছে অমলের রাস্তায় শুয়ে পড়লো অমল
ঘুম যখন ভাঙলো তখন নিজেকে হাসপাতালের একটা বেডে আবিষ্কার করলো অমল। বাড়ির লোকজন, বয়স্ক বড়বাবু সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছে এভাবে চেয়ে। আস্তে আস্তে উঠে বসলো অমল 
এই আফিমের নেশা কবে থেকে ধরেছ বাবা? বললেন বড় বাবু।
এটা ওর দোষ নয় বললেন অমলের মা। আসলে অমলের দাদুর প্রচুর বয়েস হয়েছে। মারিজুয়ানা ওনার নেশা। না দিলে পাগলামো করেন। তাই বলে সারাদিন তো দিয়ে রাখা যায়না। তাই সন্ধের সময় একটু দেওয়া হয়। ওটা নিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়েন। ডাক্তার বাবুর প্রেসকিপশন আছে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন হজমি গুঁড়োর কৌটোটা আর ওই মারিজুয়ানার পাত্রটা পাশাপাশি ড্রয়ার এ রাখা ছিল। আমি বিকালে বুঝতে পেরে ফোন ও করেছিলাম কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোনো উত্তর না পেয়ে গাড়ি নিয়ে কলকাতায় এসেছি। রাতেই খুঁজে পেয়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাই। ড্রাগের ব্যাপার বলে পুলিশ ও খোঁজ খবর করবে জানতাম তাই প্রেসকিপশন টাও নিয়ে বেরিয়েছিলাম। 

বাবা অমল এবার থেকে একটু দেখে নিয় বাবা কোন হজমি নিয়ে বেরচ্ছ, বলেন বড়বাবু। সবাই একসাথে হাসিতে ফেটে পড়েন।

Comments

Popular posts from this blog

#অনুগল্প#মোটিভ#সৌরভ_কুমার_নাথ

#ছোট_গল্প#বিজানুর_বিষে_নারদ#সৌরভ_কুমার_নাথ

#অসুখ