#অসুখ

#অসুখ
#ছোট_গল্প
#সৌরভ_কুমার_নাথ

অনেক স্বপ্ন থাকে মানুষের জীবনে। বলাইয়ের ও ছিল, খুব সাদা মাঠা কিছু। একটা ভালো চাকরি, মাথার উপরে ছাদ, একটা ছোট সংসার আর একটু ভালোবাসা। নিজের দায়িত্বগুলো পূরণ করার পর যদি সময় পায় তবে নিজের সুপ্ত বাসনা গুলোকে সার্থক হতে দেখা এটাও তার মধ্যে একটা। স্বপ্ন দেখার অধিকার সকলের থাকলেও সার্থকতাটা অনেক অংশে নিজের উপর নির্ভর করে, তবে কিছু কিছু স্বপ্ন আছে যা পূরণ হওয়ার উপর বোধ হয় মানুষের হাত থাকেনা। অপূর্ণ থাকা আলাদা বিষয়, কিন্তু অনেক অংশে সার্থক হওয়ার পরে যখন সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়, সেই আঘাত টা অনুভূত হয় বুকের পাঁজরের ভিতরে।

কোনোদিন ভালো ছাত্র হয়ে উঠতে পারেনি বলাই। একটা সাধারণ ছাত্র যেভাবে বেড়ে ওঠে ঠিক সেইভাবেই মাধ্যমিক পাস করে দ্বিতীয় বিভাগে। বাড়ির থেকে একটা চাপ ছিল বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে, নয়তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। গ্রামের বাইরে একটা কলেজে ভর্তি হতে হয় শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগে সুযোগ পাওয়ার জন্য।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরে সেই কলেজ থেকেই পাস কোর্সে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হওয়া।
যখন সমস্ত পথ শেষ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে ঠিক সেই সময় হঠাৎ এক বাল্য বন্ধুর কাছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাপারে জানতে পারে বলাই। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে বাড়ির কাছে একটা এঞ্জিনীরিং কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। পাস করে বেরোনোর পর একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় ভাগ্যক্রমে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যাওয়া একটা বড় ঘটনা বাঙালিদের জন্যে, যদিও সেই অমোঘ আকর্ষণ ছাড়িয়ে বাইরে যেতে হয় বলাইকে। কলেজে পড়াকালীন হোস্টেলে থাকার কারণে বাইরে থাকার একটা অভ্যাস ছিল, তবুও বাবা মা কে ছেড়ে দূর রাজ্যে গিয়ে কাজ করা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। একটু ভয় ছিল বুকের মধ্যে।
দিন যায় রাত আসে আবার দিন যায়, এভাবেই কেটে গেছে কয়েকটা বছর, অনেক চড়াই উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে গেছে সেই দিন গুলো, এর মধ্যে দুবার বাড়িতে এসেছে বলাই, বাড়িতে ফিরে, দিন গুলো যেন কয়েক মুহূর্ত শেষ হয়ে গেছে। ফেরার সময় বার বার পিছনে ফিরে সেই ছোটবেলার গলি গুলোকে মনে পড়েছে। সেই গোল্লাছুট, দাড়াবান্ধা, সাতচারা খেলা।
শেষে ফেরার একটা সুযোগ পায় বলাই। বাড়ি গিয়ে একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল শেষ বার, তাতেই বুঝি ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়েছে, সরকারি অফিসের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকরি। আসলে জীবন কে যতটা সোজা মনে হয়, ভদ্রলোক অতটা সোজা নন।
বিয়ে করার পরে একটা ঝড় উঠেছিল জীবনে, সেটা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। দিনের চাকা ঘুরতে থাকে আর সময় বয়ে চলে।
কিছু খবর আছে যেই গুলো সবাইকে খুশি দেয়, বাড়িতে এক ছোট অতিথির আগমন সত্যিই বলাইয়ের ঘরকে সুখের নীড় বানিয়ে দেয়। সেই ছোট্ট শিশুটার সুখ সুবিধার দিকে সকলের নজর বাড়ির বাকি মানুষ গুলিকে হটাৎ করে ধৈর্য্যশীল করে তোলে। আবার খুশিতে ভরে ওঠে সংসার টা।
এ ভাবেই ছোট তিন্নি সোনা বড় হয়ে ওঠে দিন দিন। জন্মলগ্ন থেকেই প্রচন্ড চঞ্চল তিন্নি। জন্মের দুদিন পরে পা ঘষে ঘষে পায়ের নরম চামড়া তুলে ফেলে। চিন্তা বাড়ে বলাইয়ের কিন্তু কিছু বলতে পারেনা, তিন্নির কে নিয়ে বাড়ির মানুষ গুলোর খুশি দেখে। দিন বয়ে চলে সাথে সাথে বয়েস বাড়ছে ওর। হাটা, চলা ঠিক ঠাক শিখেছে তিন্নি, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেটে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, খুব দুরন্ত।
সব ঠিক থাকলেও একটা সন্দেহ ছিল বলাইয়ের মনে। তিন্নি যেন ঠিক করে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেয়না। ডাকলে শোনেনা, অকারণে হেসে ওঠে। বাড়িতে নিজের সন্দেহের কথা জানালে বাড়ির লোকেরা বলে অবান্তর চিন্তা ভাবনা।
দের বছরেও যখন কথা বলতে সেখেনা তিন্নি তখন ও বাড়ির লোক বলে চলেছে, অনেক বাচ্চা দেরি করে কথা শেখে অত চিন্তা করার কিছু নেই।এবার বলাই আর বাড়ির লোকের কথা শুনতে চায়না। সোজা নিয়ে যায় নাম করা একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আর এটেনসন ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসঅর্ডার নাম দুটো বলাইয়ের কাছে নতুন নয় কিন্তু এর ব্যাপকতা সমন্ধে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই বলাইয়ের, মেডিক্যাল সাইন্স এর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি অর্থাৎ এই রোগের কোন মেডিসিন নেই, বলাই জানতে পারে একজন বিশেষ শিশু চিকিসকের কাছে থেকে। একমাত্র থেরাপি অনেক অংশে সুস্থ করে তুলতে পারে রোগীকে যেমন স্পিচ থেরাপি, অকূপেশনাল থেরাপি ইত্যাদি।
এর পর থেকে শুধু চেষ্টা করে গেছে বলাই। সবার অলক্ষে হয়তো চোখের জল ফেলেছে কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানবেনা সে।
এখন সবাই আছে বলাইয়ের জীবনে কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে যে জিনিসটা সবচাইতে বেশি দরকার সেই খুশিটার বড্ড অভাব ওদের। স্বপ্ন ভাঙার ব্যথাটা সবাইকে যেন নিশ্চুপ করে দিয়েছে।
তিন্নি সব সময় খুশি কিন্তু সেই খুশিকে ভাগ করে নেবার মত মানসিক স্থিতি খুশির নেই। কারণ এই ছয় বছর বয়সে এসেও নিজের মা বাবা কে ডাকা তো দূর অস্ত, খুজতেও শেখেনি।

Comments

Popular posts from this blog

#অনুগল্প#মোটিভ#সৌরভ_কুমার_নাথ

#ছোট_গল্প#বিজানুর_বিষে_নারদ#সৌরভ_কুমার_নাথ